
‘ঢাবির শতবর্ষের উপহার হোক ডিজিটালাইজেশন’
ইকবাল আজাদগণিতে স্থানীয় মান হিসেবে প্রতিটি স্থানের প্রথম সংখ্যাটি সমান গুরুত্ব বহন করে। যেমন, এককের এক, দশকের দশ। তেমনি শতকের স্থানে একশত। ক্রীড়া জগতে শতকের মানের জুড়ি নেই। ব্যাটসম্যান একটা শতক হাঁকালো কিংবা বোলার বেধড়ক মার খেয়ে শতরান খরচ করলো। উভয়ই পত্রিকার হেডলাইনে জায়গা করে নেবে। পাশাপাশি কোনো মানুষের শতবছর আয়ুতে তাকে অনেকটা ভাগ্যবানের চোখে দেখা হয়। কোনো প্রতিষ্ঠানের শতবর্ষ পেরুলে তাকে বিভিন্ন উপাধিতে ডাকা হয়। বাংলাদেশে একাধিক শতবর্ষী স্কুল-কলেজ থাকলেও নেই কোনো বিশ্ববিদ্যালয়।
১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া দেশের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এ বছরের পহেলা জুলাই বিশ্বের শতবর্ষী বিশ্ববিদ্যালয়ের দলে যোগ দিতে যাচ্ছে দেশ সেরা এই বিদ্যাপীঠ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষে পদার্পণ উপলক্ষে আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের ৫ জন শিক্ষার্থী নিজেদের ক্যাম্পাস নিয়ে তাদের ভিন্ন ভিন্ন মনোভাব জানিয়েছেন। নিজেদের আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা ব্যক্ত করেছেন। স্বপ্নবিলাসী, আশাবাদী এসব শিক্ষার্থীদের কথাগুলো তুলে ধরা হলো।
লালিত স্বপ্নের বাস্তব জয়
বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরাসি ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগের ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী তাসনীম তামান্না। তিনি বলেন, প্রতিটি মানুষের একেকটা স্বপ্নের সিঁড়ি থাকে। যার প্রতিটি ধাপে ধাপে সজ্জিত থাকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য। স্বপ্নই মানুষকে জীবনের গতিপথে চলার তাড়না যোগায়। বর্তমান থেকে একধাপ পেছনে গেলে, আমরা সেই স্বপ্নের সিঁড়িতে ওঠার প্রত্যেকটি ধাপের স্মৃতি মাঝে-সাঝেই রোমন্থন করি। আমি তখন কলেজের ১ম বর্ষে পড়ি। স্বপ্নের সেই পরিপুষ্ট বীজটি গ্রোত্থিত করে দিয়েছিলেন আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক অধ্যাপক কল্পনা রাণী রায়। উনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন। তাঁর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙ্গিনায় কাটানো জীবনের মূল্যবান সময়ের কথা বলে বলে আমার সুপ্ত লালিত স্বপ্নকে প্রতিনিয়তই জাগ্রত করতেন।
প্রতিদিন পড়ার চেয়ে উনার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কিত কথাগুলো আকুলিত হয়ে শুনতাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা! তাঁর মুখে উচ্চারিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা শুনেই ভালোবেসে বুকের গহীনে জায়গা দিয়েছিলাম অদেখা তীর্থস্থানতুল্য ভালোবাসাকে। সেদিন মনেপ্রাণে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে, আমার সুপ্ত স্বপ্নকে সঠিক পরিচর্যা এবং পরিশ্রমের আদলে সত্যি করার এক্ষুণি মোক্ষম সময়। তারপরের কথা আর না বললেই নয়! স্বপ্নের সিঁড়িতে একধাপ একধাপ করে শত চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে স্বপ্নকে বাস্তবায়নে সক্ষম হয়েছি। বর্তমানে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে ফরাসি ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগে পড়াশোনা করছি। শেষ করতে চাই পৃথিবীখ্যাত একটি উক্তির মাধ্যমে। এ পি জে আব্দুল কালাম বলেছেন,
‘স্বপ্ন সেটা নয় যেটা মানুষ
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখে;
স্বপ্ন সেটাই যেটা পূরণের প্রত্যাশা,
মানুষকে ঘুমাতে দেয় না।’
শতবর্ষে শপথ হোক মানসিকতার পরিবর্তন
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ভাষা বিভাগের ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী তারিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, ১৯২১ সালে যে বিশ্ববিদ্যালয়টি যাত্রা শুরু করেছিল অখণ্ড ভারতবর্ষের পূর্ববঙ্গে, সময়ের পরিক্রমায় সেই বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেছিল একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। বাংলাদেশের স্বাধীনতা থেকে শুরু করে তার আগে এবং পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে অনস্বীকার্য অবদান। দেশের জন্য এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা সবাই কম-বেশি জানে, তাই এই প্রতিষ্ঠানটি যখন শতবর্ষে পা দিতে যাচ্ছে, তখন আলোচনা ইতিহাস নিয়ে না করে একটু দৃষ্টিপাত করতে চাই আমাদের সমসাময়িক মানসিকতার উপর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে দেশ ও জাতির প্রতি আমাদের কর্তব্যের উপর।
প্রথমত, ভর্তি পরীক্ষার সময়কাল থেকেই আমাদের একরকমের বাজে মানসিকতা তৈরি করে দেওয়া হয় এটা বলে যে, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হয় না বা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো পড়াশুনা নেই’ কেউ কেউ এই উক্তিটি মগজে এমনভাবে ধারণ করে, স্কুল-কলেজে সেরা হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পাশ করতে টানাটানি লেগে যায়। যখন একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে প্রধান কর্তব্য হল পড়াশুনা করা এবং নিজেকে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করা, তখন অনেক শিক্ষার্থীকেই দেখা যায় রঙিন দুনিয়ায় বেহুশ হয়ে পড়ে থাকতে। এই শিক্ষার্থীদের যখন হঠাৎ হুশ হয়, তখন আর খুব বেশি কিছু করার থাকে না।
দ্বিতীয়ত, প্রথম বা দ্বিতীয় বর্ষের কাউকে যখন আমরা ডিপার্টমেন্টের পড়াশুনা কিংবা জীবনের তাগিদে চাকরির জন্য পড়াশুনায় মনোযোগ দিতে দেখি, আমরা তাকে ‘আতেল’ ট্যাগ দিয়ে দেয় অথচ যে প্রতিষ্ঠানটি একটি রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে সে প্রতিষ্ঠানটি থেকে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যোগ্যতাসম্পন্ন ‘আতেল’ বা ‘পণ্ডিত’ বের হবে-তাই কি স্বাভাবিক নয়?
তৃতীয়ত, ‘শিক্ষক পড়াতে পারেন না’ এই অভিযোগখানা আমরা হরহামেশা করে থাকি। কিন্তু, কোনো ক্লাসের আগে এবং পরে ঐ বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করা যে আমাদের দায়িত্ব, এই জিনিসটা নিয়ে আমরা একটু শব্দও করি না। আমাদের সবকিছুর দায়ভার চাপানোর জন্য শিক্ষক তথা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তো আছেনই।
ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য রক্ষায় চাই দায়িত্বশীল আচরণ
বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগের ১ম বর্ষের শিক্ষার্থী নাফিসা তাবাসসুম মিথিলা। তিনি বলেন, স্বপ্নটা এত পথ ঘুরে হাতের মুঠোয় এসে ধরা তো দিলো, তাও আবার সেই মাহেন্দ্রক্ষণে-যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর শতবর্ষে পদার্পণ করতে চলেছে, তখন নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছিল। শতবর্ষ পূর্তি নিয়েও কত জল্পনা-কল্পনা তৈরি হয়েছিল মনে! ভেবেছিলাম, কত ঘটা করে পালন হবে এ ‘জন্মদিন’, আমি তার সাক্ষী হব! কিন্তু নিয়তি তো তা হতে দিলো না। এই ‘করোনা’ কালে এহেন জনসমাগম ঘটানো উদযাপনের কোনো সুযোগই নেই।
১ম বর্ষের শিক্ষার্থী হিসেবে আমার ক্যাম্পাস জীবন মোটে ৩ মাসের। তাই তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো স্মৃতি হয়তো তৈরি হয়নি এখনও, তবে স্বপ্নের এই ক্যাম্পাসটার প্রতি একটা ভালোবাসা জন্মে গেছে ইতোমধ্যেই। করোনা পরিস্থিতিতে ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় তাই অনুভবও করছি ক্যাম্পাসের শূন্যতা।
উন্নত হোক গবেষণা খাত
বিশ্ববিদ্যালয়ের জাপানি ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগের ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী কাওছার আহমেদ। তিনি বলেন, ‘সত্যের জয় সুনিশ্চিত’ এই নীতিবাক্যকে সামনে রেখে বাঙালি জাতির আলোকবর্তিকা, স্বর ও সুরের প্রতীক, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার উর্বর ক্ষেত্র, সব অধিকার আদায়ের আন্দোলনের সূতিকাগার, জাতির বিবেক হিসেবে স্বীকৃত অদম্য ও অপরাজেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কালের পরিক্রমায় পদার্পণ করল শততম বছরে।
সেই ১৯২১ সালের পহেলা জুলাই থেকে পথচলা শুরু করা এই বিশ্ববিদ্যালয় এখন পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন গতিতে সৃষ্টি করে চলেছে একের পর এক অমর কাব্য। এই সুদীর্ঘ পথচলায় যেমন অনেক ইতিহাসের সাক্ষী হয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয় তেমন জন্মও দিয়েছে অসংখ্য ইতিহাসের।
যুগের সাথে তাল মিলিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশ ও সমাজের বিকাশ, অগ্রগতিতে অবদান রাখা উজ্জ্বল সারথীদের প্রস্তুত করে চলেছে। প্রতিবছর এখান থেকে বের হচ্ছে মানসম্পন্ন গ্র্যাজুয়েট, যারা দেশের প্রশাসনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাখছে অসামান্য অবদান।
ডিজিটাল ঢাবি হোক শতবর্ষের উপহার
বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরাসি ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগের ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী ইসরাত জাফরীন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সাথে যে প্রতিষ্ঠানের নামটা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে, তা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯২১ সালের জুলাই মাসে অবিভক্ত ভারতের পূর্ববঙ্গে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তারপর সময়ের গতিপথ ধরে সামনে এগিয়েছে। ক্রমান্বয়ে দশক, যুগ, অর্ধশত বছর ইত্যাদি ধাপ পেরিয়ে এসেছে। এ বছরের পহেলা জুলাই দেশের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে শতবর্ষে পদার্পণ করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
কতশত মানুষের হাজারটা স্বপ্নের উত্থান-পতনের সাক্ষী হয়ে আছে এই শতবর্ষী প্রতিষ্ঠান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ব্যাপারটা আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করে, তা হলো এখানকার সবার মেলবন্ধন। কোনো বিপদে পড়লে সিনিয়র ভাইয়া-আপু থেকে শুরু করে ক্লাসমেট, জুনিয়র সবাই যেভাবে এগিয়ে আসে, তা সত্যিই অবাক করার মতো। এই প্রতিষ্ঠান আমাকে দিয়েছে কিছু বন্ধুসুলভ শিক্ষক, প্রাণের বন্ধুবান্ধব এবং নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার একটা প্ল্যাটফর্ম। মনের গহীনে স্বপ্ন ছিল ঢাবি পরিবারের সাথে নিজেকে যুক্ত করার আর তা করতে পেরেছি। সেই হিসেবে বলতে গেলে প্রাপ্তির ঝুলি কিন্তু কম নয়।
শতবর্ষে ঢাবির কাছে আমার চাওয়া, প্রশাসনিক-একাডেমিকসহ সব কাজ ডিজিটাল অটোমেশনের আওতায় আনা। ডিজিটাল এই যুগে ঢাবির ডিজিটাইজেশন জরুরি। পাশাপাশি আবাসন সংকট নিরসন করে সব শিক্ষার্থীর জন্য সুষ্ঠু আবাসনের ব্যবস্থা করা। এটাই হোক শিক্ষার্থীদের জন্য ঢাবির শতবর্ষের উপহার।
ঢাবি/হাকিম মাহি
from Risingbd Bangla News https://ift.tt/3iieR6a
0 comments:
Post a Comment